সাংবাদিকের অনুসন্ধিৎসু মন, তারা তথ্য তো খুঁজবেই, এতে অপরাধের কিছু দেখছি না বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্ট বলেন, ‘সাংবাদিকদের সুযোগ করে দিলে সে তো তথ্য প্রকাশ করবেই।’
বুধবার (৩ ফেব্রুয়ারি) ফেনীর নুসরাত জাহান রাফির ভিডিও প্রকাশ হওয়ায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের জামিন আবেদনের শুনানিতে বিচারপতি হাবিবুল গনি ও বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এমন মন্তব্য করেন।
এদিন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমডি রেজাউল করিম। ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মুরাদ রেজা।
এরপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় দণ্ডিত সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের জামিন আবেদন তিন মাসের জন্য মুলতবি (স্ট্যান্ডওভার) করে আদেশ দেন হাইকোর্ট।
শুনানিতে মোয়াজ্জেম হোসেনের আইনজীবী মুরাদ রেজা বলেন, ‘মাই লর্ড, ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন ওই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেননি। তার মোবাইলে করা ওই ভিডিওটি একজন সাংবাদিক ওসির মোবাইল থেকে নিয়ে প্রকাশ করেছেন। তাই এক্ষেত্রে ওসির কোনো অপরাধ নেই। যদি অপরাধ হয় তাহলে সেটা ওই সাংবাদিকের। কারণ তিনি ভিডিওটি প্রকাশ করেছেন।’
এসময় আদালত আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘সাংবাদিকের অনুসন্ধিৎসু মন, তথ্য তো খুঁজবেই, এতে অপরাধের কিছু দেখছি না। সাংবাদিকদের সুযোগ করে দিলে সে তো তথ্য প্রকাশ করবেই।’
এসময় আদালত মোয়াজ্জেম হোসেনের আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘একজন ওসি একটি থানার দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। তিনি সাধারণ কেউ নন। তাহলে তিনি কেন তার ব্যক্তিগত মোবাইলে ভিডিও ধারণ করলেন? আমারাতো তার ওই ভিডিও ধারণ করাটাকেই অপরাধ মনে করছি। আর বিচারিক আদালত তো এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই সাজার রায় দিয়েছেন।’
এ পর্যায়ে আদালত মোয়াজ্জেম হোসেনের জামিন আবেদনের শুনানি আগামী তিন মাসের জন্য মুলতবি (স্ট্যান্ড ওভার) করে আদেশ দেন।
ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে তার মা ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ থানায় অভিযোগ দাখিল করেন। এরপর ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন নুসরাতকে থানায় ডেকে নিয়ে তার জবানবন্দী রেকর্ড করে ভিডিও ধারণ করেন এবং তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন।
পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল মারা যান নুসরাত। ওই ঘটনায় পৃথক একটি মামলায় তদন্ত শেষে ১৬ জনের বিরুদ্ধে ফেনীর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
অন্যদিকে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার পর নুসরাতের জবানবন্দীর (ওসির কাছে দেয়া) বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (ফেসবুকে) সকলের সামনে আসে। এরপর ডিজিটাল মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন ঢাকার সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেন।
ট্রাইব্যুনাল বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৬, ২৯ ও ৩১ নম্বর ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয় ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে। এরপর পিবিআইয়ের প্রতিবেদন পাওয়ার পর সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।
এরপর পলাতক অবস্থায় ২০১৯ সালের ১৬ জুন হাইকোর্টে এসে আগাম জামিনের আবেদন করেন মোয়াজ্জেম। ওই দিনই হাইকোর্ট এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাকে সাইবার ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে আদালত তার জামিন আবেদন খারিজ করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরপর বিচার শেষে ২০১৯ সালের ৭ ডিসেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এই মামলায় ওসি মোয়াজ্জেমকে আট বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে রায় দেন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল।
অন্যদিকে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার মামলায় ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ ১৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ওই রায়ের ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপিল আবেদন এখন হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায়।